দীপক সাহা
লোকসংস্কৃতির আঁতুড়ঘর জঙ্গলমহলে কৃষিজীবী মানুষের একঘেয়েমি কাটাতে যে সমস্ত পরবের জন্ম হয়েছিল, তাদের মধ্যে বাঁদনা অন্যতম। বাঁধনা পরব বা বাঁদনা পরব মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল, বিহার, ও ওড়িশার জনজাতির কৃষিভিত্তিক উৎসব। প্রতি বছর কার্তিক মাসের কালীপুজোর অমাবস্যায় এই উৎসব হয়। বাঁদনা পরব জঙ্গলমহলের আদিবাসী ভূমিপুত্রদের ঐতিহ্যময় সংস্কৃতি। তাঁদের নিজস্ব উৎসব। বাঁদনা পরব আসলে আমন চাষের শেষে গরুগাভীদের বন্দনা করে কৃতজ্ঞতা জানানোর রীতি। মাঠের ফসল ঘরে তোলার আগে বাঁদনা পরব অনুষ্ঠিত হয়। বাঁদনা পরবের অন্তরালে রয়েছে জঙ্গলমহলের মানুষের নিতান্তই নিজস্ব কর্মসংস্কৃতি। এই পরব মূলত গোমাতার বন্দনা বা পুজো করা হয়। পরবের শেষ দিনে খুঁটিতে গরুদের বেঁধে রেখে শারীরিক কসরৎ করানো হয়। লোকসংস্কৃতির বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্দনা থেকে কিংবা বন্ধন থেকেও ‘বাঁদনা’ শব্দটা এসে থাকতে পারে।
এই পরবের প্রধান উদ্দেশ্য চাষবাস শেষ হওয়ার পর ও নতুন করে চাষের মরশুম শুরু হওয়ার প্রায় মাঝামাঝি সময়টিতে মূলত কৃষিকাজে ব্যবহৃত বলদ-মহিষকে তাদের আলস্যের ভাব কাটিয়ে তোলা এবং নতুন উৎসাহ উদ্দীপনায় কৃষিকাজে মন দেওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতিকর্ম। উৎসব পালনের জন্য গ্রামে গ্রামে সাজো সাজো রব পড়ে যায়। বাজার হাটে নতুন মাটির হাঁড়ি, সরা, মাটির প্রদীপের পাশাপাশি, কুলো, ঝুড়ি কেনাকাটা চলছে। উৎসবের আগে থাকতেই এলাকাবাসীর মুখে মুখে ফেরে বাঁদনা পরবের গান, “কনও নদী বহে হবকি ডবকিয়া কনও নদী বহেই নিরাধার/ কাঁসাই নদী বহে হবকি ডবকিয়া সবন্নখা বহে নিরাধার।”
এই উৎসবের নানা অঙ্গ আছে যা জঙ্গলমহলের একান্তই নিজস্ব। মহুল গাছের কড়চা ফল ও তিল একসঙ্গে পিষে যে তেল হয় তা দিয়েই প্রদীপ জ্বালানো হয়। রাত্রে ঘরে ঘরে আলো,গোয়ালে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা, গরু মোষকে স্নান করিয়ে তেল সিঁদূর মাখিয়ে টাটকা ঘাস খেতে দেওয়া, সন্ধ্যায় ধামসা-মাদলের বোল, গরম কড়াইয়ের তেলে সুস্বাদু গন্ধ ছড়ানো পিঠে গড়া, রাত্রে গরু জাগানোর গান, কোকিলা মঙ্গল, ওহিরা সঙ্গীতে মুখরিত জঙ্গলমহল। এই উৎসবে যে গান গাওয়া হয়, তাকে অহীরা গান বলা হয়।
অনুষ্ঠানের জন্য তোড়জোড় শুরু করে মালকিন, অর্থাৎ গৃহস্বামিনী। সেই ভোর থেকে সারা ঘর গোবর গুলে ধোওয়া, স্নান সেরে দেহশুদ্ধি করে পূজার্চনার আয়োজন, গরুয়া গোসাইয়ের সেবা বা গোয়ালপুজো। গৃহবধূ স্নান সেরে নতুন কুলোটি ধুয়ে আতপ চাল নিয়ে ঢেঁকিশালে রওনা হয়। আর মরদটি রাত্রি জাগরণের ক্লান্তির ছাপ নিয়ে জঙ্গলে যায়। নিজের পছন্দসই ছোটো শালগাছ কেটে বাকল ছাড়িয়ে তিনটুকরো করে ঘরে ফেরে। ফিরে কৃষিকার্যের হাল হাতিয়ার, অর্থাৎ লাঙল, মই, জোয়াল, বাড়ির কাছের ডোবাটিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিজেও গাত্রশুদ্ধি করে। তারপরে পুজোপাঠে মন দেয়।
গরুয়া গোঁসাইয়ের প্রধান পুজোবেদি হল গোয়াল। সেখানে খামখুঁটোর গোরায় পশ্চিম পার্শ্বে স্থাপিত হয় বেদি এবং খড়। ধোয়া লাঙ্গল-জোয়াল-মই, তুলসী থানে তিন টুকরো শালকাঠের ওপর অর্পণ করে গৃহস্বামী এই পর্বে প্রথম পুজো সাঙ্গ করে গোয়ালে যায়। গৃহস্বামিনী বা কূলবধূ গোয়ালের এক কোণে পূর্ব কিংবা উত্তর মুখো তিনটি পাথরের টুকরো দিয়ে তোরণ নির্মাণ করে। গরুয়া গোঁসাইয়ের উদ্দেশ্যে অব্যবহৃত নতুন কড়াইয়ে পিঠে হয়। গরুয়া গোঁসাইয়ের উদ্দেশ্যে অর্পিত হয় আরও একটি বিশেষ ফুল। স্ত্রী শালুক কুঁড়ি। পুকুর থেকে সংগৃহীত পচা পাঁকের ওপর শালুক কুঁড়িকে গুঁজে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, এই শালুক কুঁড়ি নিয়ে আসে আদিবাসী গ্রামের শিশু ও কিশোরীর দল। প্রতি বাড়িতে তিনটি শালুক কুঁড়ির বিনিময়ে নেয় পিঠে। আমরা জানি, শালুক ফোটে মূলত মধ্যরাত্রে। সেই ফুল ফোটার আগে অক্ষতযোনি শালুক এই কিশোরীরা তুলে আনে। গরুয়া গোঁসাইয়ের উদ্দেশ্যে সমর্পিত পচা পাঁক এবং শালুক কুঁড়ি যেন অপাপবিদ্ধা কোনও কিশোরী।
প্রধানত এই পুজোর বিধিবিধান ব্রাহ্মণ্য শাসিত নয়। বৈদিক অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ এই পুজোয়। পুরোহিত বা দেহরী স্বয়ং গৃহস্বামী। পুজো ও উপবেশন পদ্ধতি ঝাড়খণ্ডী। উপবেশন ভঙ্গিমা বাম হাঁটু উল্লম্ব রেখে ডান হাঁটু মুড়ে ধরাপৃষ্ঠের সঙ্গে সমতলে অবস্থান। আদিবাসী জনজীবনে এই আর্য প্রভাবহীন আসনই কি প্রকৃষ্ট প্রমাণ নয়?
এই পরবের অন্যতম আকর্ষণ গরুখুঁটা বা কাড়াখুঁটা বা বুঢ়ীবাঁধনা নামক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে কিছু গরু বা মোষকে নির্বাচন করে তাদের গায়ে লাল ছোপ এবং কপাল ও শিংয়ে কড়চার তেল ও সিঁদুর লাগিয়ে গলায় মালা, ঘণ্টা ও ঘুঙুর বেঁধে তাদের খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়। বিকেলবেলায় গ্রামের মোড়ে গরুগুলিকে একত্র করা হয়। মাঠের ভেতরে চালের গুঁড়ো দিয়ে ঘর কেটে ছাঁদনদড়ি ও বাঁধনদড়ির পুজো করা হয়ে থাকে। এই পুজোকে গোঠপুজো বলা হয়। পুজো শেষ হলে আলপনা এঁকে তার ভেতরে ডিম রেখে দেওয়া হয়। এরপর ঢাক, ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হলে গরুগুলি ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। কোন গরু সেই ডিম মাড়িয়ে দেয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখা হয় এবং সেই গরুর মাথায় তেল, সিঁদুর ও ধানের শিষ দিয়ে সাজানো হয়। সেই সঙ্গে চলে অহীরা গান ও নাচ।
রাত্রে গৃহিনীরা নতুন বস্ত্র পরিধান করে কুলোয় ধান, দূর্বা, আমের পল্লব, হলুদ জল ও ধূপ ধূনা দিয়ে নিম্নে বর্ণিত ছড়া সুর করে গেয়ে গরুকে বরণ করেন। গভীর রাতে গোয়ালে ঘিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ও উঠোনে কাঠের আগুন জ্বেলে রাখা হয়। যুবকেরা বাড়িতে বাড়িতে গরুদের জাগিয়ে রাখতে যায়। এই যুবকদের ধাঁগড়িয়া বা ধাঁগড় বলা হয়। তারা অহীরা গান করে ও বাজনা বাজিয়ে বাড়িতে বাড়িতে গেলে গৃহস্থরা তাদের স্বাগত জানায়। কুলবধূরা পিটুলী গোলার সঙ্গে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে ধাঁগড়িয়াদের সঙ্গে হোলি খেলেন।
অমাবস্যার পরের দিন লাঙল, জোয়াল, মই প্রভৃতি চাষের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করা হয়। গৃহকর্তা জমি থেকে এক আঁটি ধান কেটে এনে ধানের শিষ দিয়ে অলঙ্কার তৈরী করে গরু বা মোষের শিংয়ে পরিয়ে দেওয়া হয়। চাষের যন্ত্রপাতিগুলিকে পুজোর পরে ঘরের ছাদে রেখে আসা হয়। এগুলিকে মাঘ মাসের প্রথম দিনে হালপুহ্নার দিনে নামিয়ে আনা হয়।
বাঁদনা পরবের ব্যাপ্তি অনেক বড়ো, মূলত গো বন্দনা, মেলবন্ধন ও সম্প্রীতির মহা পরব। কিন্তু এখন সেই মহা পরবের উৎসাহ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন সব দায়সারা গোছের। নবীন প্রজন্মের ঝোঁক এখন অন্যদিকে। কেউ আর নতুন করে গান শিখতেও চায় না, গান গাইতেও চায় না। জনজাতির নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। কোন জনজাতির সংস্কৃতির আলো ফিকে হওয়ার সাথে সাথে সেই জনজাতির অস্থিত্বও প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে। পুরনো মানুষগুলো চলে যাবার সঙ্গে একসময় বাদনা উৎসবের টানটুকুও খসে পড়বে। এর স্মৃতিটুকুতেই যা উত্তাপ।
ঋণস্বীকার–তরুণদেব ভট্টাচার্য,অমিত মাহাত, কিংশুক গুপ্ত
ছবি – আন্তর্জাল
দীপক সাহা (প্রাবন্ধিক)
পশ্চিমবঙ্গ
Leave a Reply